-->

ক্ষুধাষঙ্গ জীবনের মহাসঙ্গীত : ‘ভাতফুল ভাতগন্ধ’ - ড. চঞ্চলকুমার মণ্ডল


 

ক্ষুধাষঙ্গ জীবনের মহাসঙ্গীত   অনিল ঘড়াই-এর ‘ভাতফুল ভাতগন্ধ’   ড. চঞ্চলকুমার মণ্ডল

একজন কথাসাহিত্যিককে আগে হতে হয় মূলত: কবি। সেই অর্থে অনিল ঘড়াইয়ের শিল্পীমন কাব্যময়তায় ভরা। তাঁর গদ্য ভাষার শব্দ শরীরেও স্বচ্ছ-সহজ-সরল পদ্যের প্রক্ষেপ লক্ষ্য করার মতো। আসলে, সেই স্কুল জীবন থেকে তাঁর প্রিয় হবি ছিল কলমের নিবে সুতো জড়িয়ে মোটা কালির আঁচড় টেনে কার্টুন আঁকা; এবং সেই কার্টুনের সঙ্গে বানিয়ে বানিয়ে দু-চার লাইনের কবিতা লিখে দেওয়া। আবার, সেই স্কুল বেলাকার বন্ধু-বান্ধবদের অনেকেই তাদের প্রেমিকাদের জন্যে ঐ কার্টুনের সঙ্গে দু-চার লাইনের ছড়া লিখিয়ে নিত। এভাবেই, সেই কিশোর বয়স থেকেই কবিতা লেখায় হাতে খড়ি। তাই ছোটগল্প-উপন্যাস সৃষ্টির পাশাপাশি কলমে আঁচড় কাটতে-কাটতে বেশকিছু  কবিতা লিখে ফেলেন। যে কথা তিনি গল্প-উপন্যাসে বলতে চেয়েছেন, যে ছবি তিনি গদ্য শরীরে আঁকতে চেয়েছেন, কিন্তু সে কথা সম্পূর্ণ বলা হয়ে ওঠেনি। যে ছবি মনের মতো করে ফুটিয়ে তোলা যায়নি; সেই কথা, সেই ছবিই শিল্পী মনের অতৃপ্ততা থেকে কাব্যাকারে প্রকাশিত হয়। কাব্য শরীরেও ফুটে ওঠে কঙ্কাল সার গ্রামজীবনের ঘর-গেরস্থালীর ছবি। প্রান্তিক চলমান জীবনের ব্যথা-বেদনা, অশ্রু-ঘামে সিক্ত হতাশাদীর্ণ নর-নারীর স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের নিদারুণ মর্মন্তুদ ছবি কাব্য শরীরেও ফুটে উঠেছে। তাঁর কাব্যের পঙ্‌ক্তিমালা জুড়ে ঘুরে-ফিরে এসেছে মাটি-প্রেম-প্রকৃতি ও সেই প্রকৃতির অনুষঙ্গে জীবন ও মৃত্যু ভাবনা। মাটির মমত্ব আর ক্ষুৎকাতুরে শ্রমমুখর মানব জীবনের মহিমা ঘোষণার পাশাপাশি, ঐ দীন-হীন মানুষের বেদনার দোসর হয়ে প্রকৃতিকে এঁকেছেন। সুখপাঠ্য হিসেবে অত্যন্ত সারল্যময় কাব্য ভাষার কায়া নির্মাণে সজীবতা লাভ করেছে; বিশেষত: অসংখ্য চিত্রবহুল উপমা ঘন বর্ণময় সব বিচিত্র রকম বর্ণনা কৌশলে।

       উপন্যাস-গল্পশিল্পের ভাবনার স্রোত তাঁর কাব্য ভাষায়ও সাবলীল গতিতে ফুটে উঠেছে। কবি অনিল ঘড়াই তাঁর কাব্য ভাষায়ও গেয়ে উঠেছেন জঠর সংগ্রামী ক্ষুৎপিপাসু নর-নারীদের ক্ষুধার গান। ‘ভাতফুল ভাতগন্ধ’ এই ক্ষুৎকাতুরে জীবনের মহাকাব্য। যে ক্ষুধার নির্মমতার ভেতর দিয়ে তিনি জীবনবোধের উত্তরণের পথ খুঁজে ফিরেছেন। কাব্যকায়া নির্মাণের ভেতর দিয়ে অভাবী সংসারের জীবনযন্ত্রণায় টিকে থাকা যুদ্ধকথার পাশাপাশি ঐ চির দুঃখী গৃহচারী মানুষের যাপনযন্ত্রণার ভেতর দিয়ে কবি মনে, জীবনের আসল ঐশ্বর্যকে খুঁজে ফেরার দুর্বার আকাঙ্ক্ষাও লক্ষ্য করার মতো। তাঁর সবকটি কাব্য শিল্প ঘিরে বাংলা দলিত কবিতার একটি স্বতন্ত্ররূপ গড়ে উঠেছে। দীন-দুঃখী মানুষের হয়ে যে কথাগুলি তিনি কাব্যকায়ায় এঁকে গেছেন, তাতেও যেন তাঁর সবকথা বলা হয়ে ওঠেনি। তাই সেই অতৃপ্তির যন্ত্রণা নিয়ে শিল্পীমনের আক্ষেপ কবিতায় ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠেছে। তবুও পরবর্তী কাব্যে কবির আক্ষেপ শোনা গেছে, ক্ষুধাষঙ্গ জীবনের গান সেভাবে গেয়ে উঠতে না পারার ব্যর্থতায়—

বহু গল্প লেখা হল, খরায়

পুড়ে যাওয়া জীবন সেভাবে কবিতায় এলনা...।

এমন আক্ষেপ তো প্রতিটি শিল্পী-কবির জীবনে থেকেই থাকে। এই অতৃপ্ত বোধই হতো শিল্পীকে আবার নতুন করে লেখনী ধারণে বাধ্য করে।

       কবির জন্ম পূর্ব মেদিনীপুর জেলার এগরার রুক্মিণীপুর গ্রাম। কিন্তু, দারিদ্রগ্রস্ত পিতা ক্ষুধাষঙ্গ জীবনে লড়াই করতে গিয়ে জীবিকার তাগিদে পাড়ি দেন নদীয়া জেলার কালীগঞ্জে। শৈশব-কৈশোর থেকে যৌবনের অনেকটা সময় দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করতে গিয়ে অতি কাছ থেকে এমনকি নিজের জীবন অনুভূতি দিয়ে দেখেছেন ক্ষুধাষঙ্গ জীবন। চার পাশের অভাবের শত হাঁ-মুখ জীবন কবিকে পীড়িত করেছে। ক্ষুধার করাল গ্রাস কিভাবে মানুষের ছোটো ছোটো স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষাটুকুও কেড়ে নেয় তা অতি কাছ থেকে অনুভব করেছেন। পরবর্তী রেলওয়ের চাকরি সূত্রে ঘুরে বেড়িয়েছেন বিহারের প্রান্তিক শত দারিদ্রগ্রস্ত জনারণ্যে।  সাউথ-ইস্টার্ন-ওয়েস্টার্ন চক্রাকারে ঘুরে বেড়াতে গিয়ে শত শত দারিদ্র কবলিত ক্ষুৎকাতুরে জীবনকে অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছেন। ঐ সব ক্ষুধাষঙ্গ জীবনের অশ্রু-বেদনাকে তুলে ধরেন কাব্য-কায়া নির্মাণের মধ্যদিয়ে। মূলত: কথাশিল্পী হলেও, কবিতাই তাঁর প্রথম প্রেম। তাই, কথাশিল্পী হিসেবে যেমন পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মান, তেমনি কাব্য নৈবেদ্যের জন্য পেয়েছেন ‘কবি নিত্যানন্দ পুরস্কার’ সহ ‘আকাশ সাহিত্য পুরস্কার’। কবির কাব্য বীণায় ক্ষুধাষঙ্গ জীবনের যে মহাসঙ্গীত শোনা যায়; কথাশিল্পের ঠাসবুননেও সেই ক্ষুৎকাতুরে নর-নারীর দারিদ্রগ্রস্ত জীবনের মহাসঙ্গীত রূপে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠেছে বার বার।

১লা বৈশাখ, ১৪১৮ সালে (ইং এপ্রিল ২০১১) কবি সুনীমাঝি ও অনিল ঘড়াই যুগ্মভাবে প্রকাশ করেন ‘তুর্য’ প্রকাশনী থেকে তাঁর ষষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ হিসাবে ‘ভাতফুল ভাতগন্ধ’। সুব্রত রায় চৌধুরীর আঁকা কাব্য নামোপযোগী প্রচ্ছদ – ‘হাড় হাভাতে নারী ও শিশু বৃক্ষের তলে দাঁড়িয়ে থাক রুগ্ন ক্লিন্ন মুখচ্ছবিতে’ – কাব্য ভাবনা ফুটে উঠেছে। কবি এই কাব্য গ্রন্থে যে সাদা সাদা কুসুম ভাতের স্বপ্নে বিভোর ক্ষৎকাতুরে শ্রমমুখর মানুষের যাপিত জীবনের ছবি এঁকেছেন; সেই ছবি তাঁর ‘বিপরীত যুদ্ধের মহড়া’ উপন্যাসের নায়ক ভাগ্যধরের দুর্ভাগ্য পীড়িত জীবন চিত্রেও ফুটে উঠেছে। যে ভাগ্যধর সকাল থেকে উসখুস করছিল এক জামবাটি ভিজে ভাতের জন্য। যাকে দেখে লেখকের মৎস্য শিকারের জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষায় খুঁটি বাঁশে ঠায় বসে থাকা মাছরাঙা পাখির জীবনের সমগোত্রীয় মনে হয়েছে। এই কাব্যে ফুটে উঠেছে গ্রাম জীবনের জঠর সংকটের চিত্র। ফুটে উঠেছে প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা, যাপিত জীবনের সংকট ঘন আবহ। -

এবছর পাতাল জলে থৈ থৈ আর্সেনিক্ পোকা 

খাল দুঃখী হিজরের নাভির চেয়েও কুকান 

ভটভট চলে মেসিন, অক্ষম পাতালও পারে না ছেঁচতে জল 

তৃষ্ণা মিটবে কি দিয়ে, বাবার কপালে ভাঁজ!

অভাবী সংসারের মাঝে বসে কবি লক্ষ্য করেন পিতার রুগ্ন মুখাবয়ব। মায়ের চোখের জলে ভেসে যাওয়া অশ্রু নদী। দুঃখকে সম্বল করে অভাবী সংসারের মাঝে লড়াই করতে করতে কবির পূর্বজ মানুষেরা রয়েছে ঠোঁট ফাঁক করে। আর অভাবী সংসারের হাল টানতে টানতে কবি তাঁর মা’কে মনে করেন ‘স্বয়ং সাগর মাতা’। যে শুধু নিজেকে ক্ষয় করেও সংসারের আর পাঁচ জনের মুখে দু’বেলা দু’মুঠো অন্ন তুলে দিতে নিয়ত নীরবে সংগ্রাম করে যায়। তাই, মাটি কবির কাছে বার বার ভিন্ন দ্যোতনা বয়ে আনে। মা’-মাটির মমত্ব কবির লেখনীতে ফুটে উঠেছে বার বার। কবি তাই লেখেন; -

মাটির লবণ মেখে মা’ স্বয়ং সাগর মাতা।

আবার সেই মাটিই কবির দৃষ্টিতে বয়ে আনে ভিন্ন তর তাৎপর্য। মাটির মমত্ব মাটির মহিমা গেয়ে কবি বলেন –

অভাব আর আয়ু নিয়ে মাটিও হয়নি জ্যোতিষী।

প্রকৃতি জীবনের সঙ্গে মানব জীবনের সমন্বয় কবি খুঁজে পান। যখন কবি মা’য়ের মুখে শোনেন –

ফুলেদের আয়ু কম, ফুল ঝরে গেলে 

ফাঁকা গাছের দুঃখ বাড়ে, কুয়াশা ওদের যমরাজ।

ফুলগুলো প্রতি রাতে চাঁদ দেখে মুগ্ধ হয়। জ্যোৎস্নাও শাঁখ রঙা শরীর নিয়ে পরীদের ওড়নার মতো শরীর বিছিয়ে দেয় মাটির বিছানায় কুয়াশায় ঝরে যাবে জেনেও ফুলগুলো ঐ জ্যোৎস্না রঙ বাহার এড়িয়ে থাকতে পারে না। মানুষও মৃত্যু জীবনে নিশ্চিত জেনেও যেমন করে বাঁচার লড়াই করে যায়। মৃত্যুকে এড়িয়ে প্রকৃতি সৌন্দর্য বিমুগ্ধ হয়। কিন্তু ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে, চাঁদ দেখে ঝল্‌সানো রুটির স্বপ্ন তথা, চাঁদের সঙ্গে রুটির সমন্বয় কিশোর কবি সুকান্তের মতো কবিও দেখতে পান। কবি দেখেন তাঁর হাড় হাভাতে দারিদ্র্যগ্রস্ত পিতা চাঁদের জ্যোৎস্না কিম্বা, ফুলেদের রঙ বাহার দেখে কল্পনায় মুগ্ধ মান হতে জানে না। বোঝ না ফুল কেমন করে ঐ চাঁদের জ্যোৎস্না বাহারে মুগ্ধ হয়। শুধু গাছ ভর্তি সাদা-সাদা ফুল দেখে তাঁর খিদে আরো বেড়ে যায়। একজন ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে তাই চাঁদের শতক আর নয়, ক্ষুধা নিয়ে বিনিদ্র রজনী জেগে থাকা মানুষের চোখে গুচ্ছ গুচ্ছ ফুটন্ত সজনে ফুল দেখে সাদা সাদা কুসুমভাত ভাবাই তো স্বাভাবিক। আলেয়ার মতো শুভ্র ফুল দেখে কবির ক্ষুকাতুরে পিতা স্ফূর্তিতে ডগমগ হন। যেমন করে শিল্পীর ‘বিলভাত’ গল্পের নায়ক ক্ষুৎকাতুরে বাদলা হাতের মধ্যে ডালের মধ্যে ভেসে উঠতে দেখেছিল তার কাঙ্ক্ষিত আর এক ক্ষুধার্ত নারী পুতলির মুখচ্ছবি। কবির পিতাও তেমনি ঐ ফুলগুলো দেখে বলেন, -

জানো, গাছ ভর্তি ফুলগুলো বাড়িয়ে দেয় আমার খিদে,

গুচ্ছ গুচ্ছ সজনে ফুল বেশি করে মনে করায় ভাতের কথা!

অভাবী, দীন-দারিদ্র্যগ্রস্ জীবনের প্রকৃত শরিক হলেই বোধ হয় কবি সুকান্তের ঝল্‌সানো রুটির ভাবনাকে ছাড়িয়ে, দীনেশ দাসের ‘কাস্তে’র চাঁদের শতক পেরিয়ে – ‘ক্ষুধা’ নিয়ে এমন প্রখরতর বাস্তবতার তীব্র ঝলকে সাদা সাদা গুচ্ছ সজনে ফুলের সাযুজ্যে ভাতফুল আর উনুনের আগুন আহারের সমন্বয়ে মোটা চালের ফুটন্ত হাঁড়ি থেকে ভেসে আসা ভা গন্ধে বিভোর স্বপ্নের ছবি আঁকা যায়। তাইতো পরবর্তী ‘ভাতগন্ধ’ কবিতায় কবির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দার্শনিক সুলভ মনো ভাবনায় ধরা পড়ে, -

উনুনেরও খিদে পায়, সে খায় আগুন আহার...

কবি তাঁর বেড়ে ওঠা জীবনের চারপাশে শোনেন ক্ষুধার হা-হা কার। দেখেন, অসংখ্য ক্ষুধার্ত নর-নারীর করুণ শুষ্ক মুখচ্ছবি। তবুও কবি ঐ ক্ষুধাকে একে বারে এড়িয়ে থাকতে চান না। ক্ষুধাকে হাসি মুখে বরণ করে নিতে চান। ক্ষুধাকে জয় করতে চান। যেমন করে নজরুল ইসলামের অনুভবে ধরা পড়ে দারিদ্র্যের মহত্ব। কবি তাই, দুঃখ-দারিদ্র্যকে বরণ করে নিয়ে বলে ছিলেন –

হে দারিদ্র, তুমি মোরে করেছ মহান

  তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান।

তেমনি কবি অনিল ঘড়াইয়েরও পঞ্চ ইন্দ্রিয়ে ধরা পড়ে; -

ক্ষুধা সঙ্গ দীর্ঘায়ু করে না কোনো জীবন 

তবু ক্ষুধার ভীষণ প্রয়োজন 

খিদা তাই প্রায়শ নোঙর করে শরীরী সমুদ্রে 

রক্ত কোষে পানকৌড়ি ডুব সাঁতার।

উপমিত চিত্রকল্পে কবি ফুটিয়ে তোলেন ক্ষুধার্ত মানুষের হা হা কার। আঁকেন কর্মক্লান্ত পরিশ্রমী মানুষের অশ্রু-স্বেদ-রক্তের আলপনাক্ষুধার্ত মানুষের চোখে ভাসে সাদা সাদা কুসুম ভাতের স্বপ্ন। হাঁড়ি থেকে ভেসে আসা মোটা চালের ফুটন্ত ভাতের গন্ধে আমোদিত হয় ক্ষুধার্ত শরীর। যে ক্ষুৎকাতুরে শরীর খুশির আবেগ থর থর জলে ঝাঁপ দেয়। আর কবির তা দেখে মনে হয়, -

শিঙি মাছের মতো ভাসে পরিশ্রমী দেহ 

মোটা চালের ভাত ফোটে হাঁড়িতে 

অবশেষে ভেসে আসে ভাত গন্ধ...

সাদা ভাত কি যাদু না জানে

 ভাতগন্ধ নিয়ে ঘোরে আমাদের এই জীবন

       কবির গ্রামজীবনে ফেলে আসা শৈশবের স্মৃতি মনের মণিকোঠায় সতত: জাগ্রত। প্রতি বর্ষায় ডুবে যাওয়া সেই মেঠো পথ। যে পথে চেটো ডোবা এঁটেল মাটির কাদায় দেবে বসত পদ যুগল। সেই ঘাস-মাটির গ্রাম আজও কবির মনকে টানে। টানে, সেই ডাঙা পড়িয়ার মাঠ, তাঁতি বাড়ির চৌহদ্দি ঘেরা ক্যাকটাস সংসার। ট্যাকাটি গাছ আর নাকছাবি ফুলের বাহার। বুড়ো বটতলার চাপা কল। হাতের তালুর মতো খেলার মাঠ। যে মাঠে শৈশব-কৈশোরে অনিলরা খেলতেন ‘নুনগাদি’ খেলা। আজও কবির কানে বাজে সেই শীতলা থানে বেজে ওঠা সন্ধ্যারতির ঘণ্টা। আর এরান্দা হাট থেকে কিশোর অনিলের বাবা-জ্যাঠারা ফিরতেন বাঁক কাঁধে। যে বাঁকের ঝুড়িতে উঁকি মারত ‘চাঁদবদনি মাছ’। যা দিয়ে অভাবী সংসারের সারা ‘হপ্তার খোরাক’ হয়ে যেত। ঐ নিদারুণ অভাব গ্রস্ত জীবনে বিলাসিতা বলতে ছিল একমাত্র দু-চার আনার ‘বিড়ি’ কিম্বা, বড়জোর হুঁকোয় সাজা ‘তপকা’ তামুক। ঐ অভাবী সংসারের মাঝে বসে কবি দেখেন কি ভাবে তাঁর –

... বাবা আর জ্যাঠা মিলে 

ভেঙে দিচ্ছে সদ্য সংসারে ঢুকে পড়া অভাব সাপের বিষ দাঁত।

এভাবে, সমগ্র কাব্য-কবিতার শরীর জুড়ে ফুটে উঠেছে ‘ভাতফুল ভাতগন্ধ’ কথাঘুরে ফিরে এসেছে ক্ষুধা প্রসঙ্গযে ক্ষুধার্ত জীবনের কাছে অভাবের বিষদাঁত হার মেনে ভোঁতা হয়ে পড়েছে। যে অভাবের হাঁ-মুখো দাঁত, গরীবের ভাতের থালার স্বপ্নে লড়াইয়ের কাছে থম্‌কে গেছে। ব্যর্থ হয়েছে কেড়ে নিতে গরীবের ভাতের থালা –

... অভাবের দাঁত ভোঁতা হয়ে ফিরে গেছে বার বার 

তবু কেড়ে নিতে পারেনি গরীবের ভাতের থালা,  

সাদাভাত প্রতিদিন ফোটায় কাশফুল, ...

এরকম ‘গরীবি মেঝে’, ‘মাঠ চিকনি শাক’,চাতক পিপাসা’র মতো অসংখ্য কবিতার শরীর ঘিরে ক্ষুধার নির্মমতার ভেতর দিয়ে জীবন বোধের উত্তরণের পথ খুঁজে ফিরেছেন শিল্পী। তাঁর কবিতার শরীরে রয়েছে যেমন অভাবী সংসারের জীবন যন্ত্রণায়— টিকে থাকার যুদ্ধ কথা তথা, সংগ্রাম-সংকল্পের ছবি। তেমনি রয়েছে গৃহচারী মানুষের যাপন যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে কবি মনে জীবনে আসল ঐশ্বর্যকে খুঁজে ফেরার দুর্বার আকাঙ্ক্ষাপ্রকৃত জীবন যে ঐ শ্রম মুখর মানুষের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে তা কবি বোঝেন। আর তাই কবি মনের সরল বিশ্বাস, -

কাদা জল সংসারের শ্যাওলা সরিয়ে যে কাটে সাঁতার’

ডুব দিয়ে সে খোঁজে জীবনের আসল ঐশ্বর্য...

শিল্পীর সমগ্র শিল্প সাধনা জুড়ে ঐ একটিই লক্ষ্য, একটিই স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা ক্ষুধাষঙ্গ জীবন অনুষঙ্গে জীবন সত্যতার সুলুক সন্ধানে ডুব দেওয়া।